জ্বলদর্চি

আশিস দণ্ডপাট


আ শি স  দ ণ্ড পা ট 

বর্তমান সংকট ও  রবীন্দ্রনাথ 


পৃথিবীর গভীর, গভীরতম অসুখের দিনে আরোগ্যলাভ দূরে থাক রোগমুক্তির একটুখানি আশ্বাসের জন্য আমরা বর্তমান অথবা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নয় বরং অতীতের মনীষার কাছে প্রসারিত-হস্ত হয়ে আছি। শিল্প আমাদের তাপদগ্ধ জীবনে মরুদ্যান-বিশেষ।

    রবীন্দ্রনাথ মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম আর আত্মার শান্তি। ঔপনিষদিক ঋষির ধ্যানের ভারতাত্মাকে যথার্থ চিনেছিলেন তিনি। আর তাই একটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতাকে প্রত্যক্ষ করেও আপন বিশ্বাসের ভূমিতে স্থিতধী হতে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও বিবিধ জটিল সংকটের আবর্তেও জীবনপ্রবাহের আদিম ও চিরায়ত ধারাটি অনিঃশেষ। যদিও বিশ্ব এ-যাবৎকাল যে সংকটগুলির সম্মুখীন হয়েছে তার থেকে বর্তমানের সংকটটির শুধু কালগত নয় বরং চরিত্রগত ও পরিস্থিতিগত প্রভেদও রয়েছে যথেষ্ট। স্প্যানিশ ফ্লু, প্লেগের মতো মহামারীর স্মৃতি রবীন্দ্র-মানস-পটে থাকলেও বিজ্ঞানের যাবতীয় জয়ধ্বজাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে করোনা-ত্রাস গ্রাস করেছে তা অভূতপূর্ব। এর ভয়ংকরতা আরো প্রবল এইজন্য যে বিশ্বায়ন-পরবর্তী সময়ে পারস্পরিক সংযোগ ও সহায়তায় পৃথিবীর প্রতিটি দেশ অস্তিত্বশীল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক  এমনকি মনস্তাত্বিকভাবেও একে অপরের সঙ্গে ঘনসন্নিবিষ্ট। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবতা’র আদর্শে যে সন্নিবেশ চেয়েছিলেন, সেই আদর্শের মূলেই কুঠারাঘাত করেছে কোভিড-১৯। বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক মিলন-মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ না করে মানুষকে বলছে : বিচ্ছিন্ন থাকো, বিচ্ছিন্ন রাখো। এ যেন হঠাৎ করে নদীর স্রোতকে উৎসমুখে ফিরতে বলা। প্রাণের প্রবাহে বাঁধ পড়েছে। সময়          কেবল সময়ই বলবে সে বাঁধ ভেঙে মুক্তধারাকে গতি এনে দিতে পারবে কি না কোনো অভিজিৎ।

    ‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে/ যাব আমি চলে'... এ উচ্চারণে স্পর্ধা নেই, জীবনের জয়গান আছে। কেননা প্রাণের লীলা যতক্ষণ চলছে ততক্ষণ সর্বভূতে আনন্দময় ব্রহ্মের চিরন্তনতাকে নতমস্তকে স্বীকার করাই রবীন্দ্র-আদর্শ।

  পৃথিবীর ক্রম-মুক্তির পথ আজ আমাদের কাছে অজ্ঞেয় হলেও যে কবি সংকটের সময়ে 'তিমিরহননের গান' শুনিয়েছেন তিনি জীবনানন্দ দাশ। রাবীন্দ্রিক আদর্শের উজ্জ্বল আলোক-বলয়ের সাধনা তিনি করেননি বরং 'বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি' তাঁর বিপন্ন সময়ের স্থবিরতাকে যেভাবে কবিতায় এনেছেন তাতে ব্যক্তি-মানুষের অসহায়তাকে স্বীকরণ করে ব্যাপ্তির কথা ভাবতে শেখায়। এ ব্যাপ্তি দ্যুলোক-বিস্তারী নয়, বরং মানুষের সংসারে মানবের কথা বলে।
            ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।'

দুঃখ, বেদনা, অসহায়তায় বহিরঙ্গে শাশ্বতর অন্তর্গূঢ় সাধনা এ-ও। আধুনিক মানুষের আধুনিক সমস্যা-সংকটের ওষধি-প্রায়।

------

Post a Comment

0 Comments