জ্বলদর্চি

প্রতাপ সিংহ


প্র তা প সিং হ 

তোমার গান তো  ঘুমের ওষুধ 


অভূতপূর্ব মহামারির(করোনা ভাইরাস) দাপটে পৃথিবী জুড়ে এখন অবিরাম মৃত্যুর মিছিল চলছে। এই মহাসংকট পর্বে ভারতেও কেটে গেল লকডাউনের একমাস। আশাহীন, দিশাহারা মানুষ অনিশ্চয়তার আতঙ্কে শুধু ভাবছে এভাবে আর কতদিন যে  ঘরের মধ্যে আটকে থাকতে হবে! উদ্বেগে,উৎকণ্ঠায় এখন আমরা সবাই যেন এক দুশ্চিন্তাপুরের বাসিন্দা। এরকম ছন্নছাড়া জীবন কোনোদিন তো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। থমকে যাওয়া সভ্যতায় বাস-ট্রেন স্তব্ধ, রাস্তা -ঘাট নির্জন, স্কুল -কলেজ বন্ধ। দোকান -বাজারের হতশ্রী চেহারা, অফিস বন্ধ বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম... আড্ডাহীন, উৎসববিহীন এই চারপাশের ছবি যে মানুষ বিশ্বযুদ্ধেও দেখেনি!এমন ভূতুড়ে শত্রু বা জীবাণুর সঙ্গে যুদ্ধ কি আদৌ করা যায়? অস্ত্র তো শুধু সাবান-জল,স্যানিটাইজার আর মাস্ক এবং রণকৌশল কেবল শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। 
       
        এই অভিনব লড়াই আমরা কেউ  জানতাম না, শিখলাম। প্রতিদিনের এই যুদ্ধে আর একজন বড় সঙ্গী আমার প্রাণের রবীন্দ্রনাথ, আরও প্রবলভাবে কবির গানগুলি।উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ছোটগল্প, চিঠিপত্র, কবিতার চেয়েও গীতবিতানের পাতায় পাতায় আরো বেশি করেই যেন খুঁজে পাই বেঁচে থাকার মন্ত্র, উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আর যন্ত্রণা নিরসনের পথ। কবি আজীবন দুঃখকে লালন করে, শোক আর কান্নাসাগরকে সঙ্গী করেও অবলীলায় উচ্চারণ করতে পারেন - 'মারতে মারতে মরণটারে শেষ ক'রে দে একেবারে।'
ঝড়-ঝঞ্ঝা-প্রলয়কে সঙ্গে নিয়ে 'যেতে যেতে একলা পথে'র এই মানুষের গানই এখন আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়-ভরসা,এই ছন্দহীন জীবনের শুশ্রূষা -ওষুধ আর নিদ্রাহীন রাতের যেন এক একটি ঘুমের বড়ি। তাই যখন শুনি -- 'তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল। /সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল।' বা 'প্রাণে গান নাই,... বৃথা তোর ভস্ম -'পরে মরিস যুঝে।' কিংবা ' সংশয়তিমির মাঝে না হেরি গতি হে।' বা 'কী করিলি মোহের ছলনে।/গৃহ তেয়াগিয়া প্রবাসে ভ্রমিলি,পথ হারাইলি গহনে। ' 
অথবা 'এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাধা'...
তখন কবি হৃদয়ের এই উচ্চারণ বুকের মধ্যে বাজতে থাকে, বেজেই চলে। এই অনুরণিত প্রাণের সুরেই উদ্ভ্রান্ত - হতোদ্যম মন সাংসারিক জীবনে থেকেও একটু  স্বস্তি খুঁজে নেয় --
'আপনি  অবশ হলে তবে বল দিবি তুই কারে?
উঠে দাঁড়া, উঠে দাঁড়া ভেঙে পরিস না রে।' অথবা 
'সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান 
সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মান। '-- এই গানগুলো শুনতে শুনতে। 

     আজ ডাক্তার - নার্সরা দাঁতে দাঁত চেপে অক্লান্ত সেনার মতো লড়ছেন, গবেষক -বিজ্ঞানীরা জীবন বাজি রেখে করোনা-র প্রতিষেধক টিকা আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময়ে ঘরবন্দি হয়ে আমরাও উজ্জীবিত হতে পারি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে, নিরাপদে থাকার সঙ্গে বাজুক এই নিরাময়ের সংগীত --'অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে?/অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে।'
সারি-জারি-কীর্তন-ঝুমুর-ভাটিয়ালির সংরাগ মাখা মাটির জীবনের লোকসুধার গানই হোক বা ধ্রুপদ -ধামার-টপ্পা-ঠুংরির মূর্ছনায় ব্রহ্মসঙ্গীত কিংবা প্রেম- প্রকৃতি-বিচিত্র পর্যায়ের গানই হোক ; যে গানই হোক না কেন  কথা ও সুরের অনুপম যুগলবন্দিতে তা যে   বিশল্যকরণীর মতোই ছুঁয়ে যায়--
'মধুর মধুর ধ্বনি বাজে/হৃদয়কমলবনমাঝে।'
গানের মধ্যে দিয়েই এক অন্তহীন ব্যথাপথের পথিককে আমরা খুঁজে পাই --'দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে।'এই দুঃখের পথে যে তিনিও বারবার গেছেন। অন্তহীন পথচলায় অক্লান্ত প্রিয়পথিক সময়ের ক্ষতচিহ্ন নিয়েই একই সঙ্গে মন ও মননেও বাজতে থাকেন -
'যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা--
নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা।'
আজও  এই দুঃসময়ে যখন চারদিকে হিংসা, হানাহানি ,অজ্ঞতা,মূঢ়তা গ্রাস করে রাখে আমাদেরকে তখন মনে হয় এখনো সেই 'মূর্খ ভারতবাসী- দরিদ্র ভারতবাসী'-র গুহাতেই আছি। শুধু কষ্ট হয় এই ভেবে যে ইন্টারনেট,দূরদর্শনের কল্যাণেও আমরা মানসিকভাবে কোথায় আছি আর বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের কী গভীর দর্শন ছিল! কবি শিক্ষাকে বইয়ে নিবদ্ধ  সংকীর্ণতা থেকে, ধর্মকে শাস্ত্রের গোঁড়ামি থেকে আর বাংলা গানকে বাণীহীন সুরের প্রাবল্য ও কালোয়াতি থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। চারদিকে আজ যখন  বড় বেশি  মধ্যমেধা ও নিম্নরুচির  উৎকট আস্ফালন  আমাদের সমাজে প্রকট হতে  থাকে তখন আরো বেশি ভারাক্রান্ত হই। একান্তভাবেই বিষণ্ণ হৃদয় তখন শুনতে উৎসুক হয় : নব নব রূপে  তুমি এসো,' কিংবা ' জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো-' অথবা 'অন্ধজনে দেহ আলো,মৃতজনে দেহ প্রাণ ' প্রভৃতি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণের গানগুলি। লকডাউন পিরিয়ডের জীবনের মধ্যেও প্রেরণা পাই বেঁচে থাকার এইসব অসামান্য   গানগুলি শুনতে শুনতে --
'বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা --
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।' কিংবা 'নিশিদিন ভরসা রাখিস,ওরে মন হবেই হবে ' অথবা 
'হবে জয়, হবে জয়, হবে জয় রে,ওহে বীর,হে নির্ভয়।' করোনা মুক্ত সভ্যতার জন্যই আজ বেঁচে থাকার মরিয়া সংগ্রাম  চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে।তাই ঘরে-বাইরে  আন্তরিক প্রার্থনায় সকাতরে আজ কাঁদছে সবাই --
'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে/মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। /তব ভুবনে তব ভবনে /মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।'


-------------

Post a Comment

0 Comments