জ্বলদর্চি

পৌলোমী ভট্টাচার্য


পৌ লো মী  ভ ট্টা চা র্য 

আমাদের আকাশ


সময় জুড়ে ওলটপালট হাওয়া।  বারবার পাল্টে যাওয়া মুহূর্ত। উত্তরাধুনিক অভ্যাস। অফিস বাড়ি, টুইটার হোয়াটসঅ্যাপের নীল সবুজের খেলায় অনুরাগ বীতরাগের ঝড়ঝাপটা। গলায় টাই ঝুলিয়ে যে পুঁচকে চোখ কচলাতে কচলাতে ভোর ছটায় পুলকারে ওঠে, সে জানে না 'আঙিনা' কি! 'আঙিনা' মানে 'উঠোন ' বলে দিলে সে জিজ্ঞাসা করে 'উঠোন 'কি?
কারণ সে উঠোন দেখেনি! ৯০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে কাঁথা থেকে হামাগুড়ি দিতে দিতে তার প্লে স্কুল! সেখানে  উঠোনই বা কী! আর সেই উঠোনে 
বসে পড়া "চিঠি"রই -বা মানে কী!  জন্ম থেকে তো তার স্টাডি মেটেরিয়াল 'মেল' করেছে স্কুল টিউটোরিয়াল। মায়ের মন খারাপ হতে দেখেছে বটে! কিন্তু,"বাবার চিঠি হাতে/চুপ করে কি ভাবিস বসে ঠেস দিয়ে জালনাতে" , ....তার কাছে দুর্বোধ্য। তাকে এসব বোঝাতে হয় আলাদা করে। তবু একটা বিরাট আকাশ ঝুঁকে থাকে রোজ আমাদের মাথার ওপরে। সকাল থেকে সন্ধে। আমরা চলি, সেও চলে। সকালের ঘোড়দৌড় সন্ধের ক্লান্তি অ্যালকোহলে চুবিয়ে নেয় সারা দিনের হিসেবনিকেশ। আকাশটা তখনও তৈরি তার তারাদের নিয়ে। আমাদের সবসময় খেয়ালও থাকে না। তবে হাতড়ে  হাতড়ে খোঁজ নেয় ঠিকই একসময় মন। কারণ তার শুশ্রূষার বড় প্রয়োজন। প্রয়োজন অখণ্ড ভরসার। সেই ভরসাটুকুই তো একলা সন্ধের আলো না  জ্বলা ড্রইংরুমের সঙ্গী। সারাদিনের জার্নালে ডেবিট-ক্রেডিট এর আড়ালে পড়ে থাকা এক টুকরো সঙ্গসুখ।"আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি, তুমি অবসরমত বাসিয়ো/নিশিদিন হেথায় বসে থাকি, তোমার যখন মনে পড়ে আসিও"। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার পোশাকি খেলাটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে মুহূর্তে। দেখা হয়ে যায় নিজের সঙ্গে নিজের।ভোরবেলার পাখি ডাকা আবছা আলোয় ছোট আমি থেকে বড় আমির দিকে যে পথ তৈরি হয়েছিল গোটা রবীন্দ্র পরিক্রমণ জুড়ে সেখানে হেঁটে যাওয়ার ফুরসত এ জীবনের হয়তো নেই, কিন্তু আশ্বাসটুকু আছে ষোল আনা।"সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে/সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা/তোমারে যেন না করি সংশয়".... এ যেন সারা দিনের হাঁটাহাঁটির শেষে কর্পোরেট আস্ফালনের সামনে লিটল ম্যাগের সর্বস্ব পণ রাখা প্রেম !
"যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি/ঝড় উঠেছে ওরে এবার ঝড়কে পেলেম সাথি"।
ঝড়কে সাথী করার ইচ্ছেটুকুই তখন জীবনের পুঁজি,যেখানে গোধূলি আলোতে তারা ঢেকে গেলে দেখা হয়ে যায় হঠাৎ একদিন তারই সঙ্গে, যার সঙ্গে দেখা করার জন্য যুগ থেকে যুগে আমাদের সবার অপেক্ষা।
এখন হাতঘড়ি হারিয়ে গেছে আমাদের, সময় এখন ডিজিটাল শাসনে। তবু কব্জির ক্যাফলিনে  আটকে যায় চোখ...কখন যে "স্তবের বাণীর আড়াল টানি তোমায় ঢাকি"... মন ঠাওর পায়না। পূজা নাকি প্রেম? জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঝুলে থাকে আজীবন! উত্তর খুঁজুক মহাকাল। আসলে দুটোই তো জড়াজড়ি করে ধরে রেখেছে দুটোকে। আলাদা করা যায় না কি! সব সংশয় থেকে চিবুক তুলে জীবনকে আদর করে আশ্বাস।"সকল পাওয়ার মধ্যে পেয়েছি অমূল্য উপাদেয়/এমন সম্পদ যা হবে মোর অক্ষয় পাথেয়"। ভালোমন্দের নিক্তি ওজনের চুলচেরা সংশয় গুলোর মাঝখান থেকে ফুঁড়ে বের হয় "তোমার মাপে হয়নি সবাই, তুমিও হওনি সবার মাপে,তাই বলে কি সবার সঙ্গে ঝগড়া করে মরতে হবে.... মনেরে আজ কহ যে ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে"... এই সহজ বিশ্বাসের দমটুকুই শেষপর্যন্ত সম্বল। 
উল্টে পাল্টে যাওয়া একটা সময়ের ঘাড়ের ওপর চেপেছি আমরা। দৌড়াচ্ছি, কেবলই দৌড়াচ্ছি। চলকে পড়ছে আলো , ঝলসে যাচ্ছি নিজেই। আঙ্গুল চেপে চেপে মুছে দিচ্ছি অতীত। ছোট্ট একটা শব্দ, ডিলিট'!
আর গ্যালাক্সির ঘূর্ণিপাকে পাক খেতে খেতে যাবতীয় আত্মাভিমানের সত্যকে মিথ্যা ভাবতে কষ্ট পাচ্ছি। অথচ নির্মেদ সেই উচ্চারণের সামনে আমরা সবাই নতজানু। কারণ সে যে "সত্য"! আর "সত্য যে কঠিন/কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,/সে কখনো করে না বঞ্চনা".... এখানেই সব সংশয় থেকে আমাদের ক্রমমুক্তি। অনন্ত বঞ্চনার বেড়াজাল কেটে পরম আশ্রয়টুকুর জন্য আমাদের অনবরত আবর্তন। সে আবর্তনের একটিই নাম রবীন্দ্রনাথ। আমাদের আশ্রয়।
"আজ আমি কোনো মোহ নিয়ে আসিনি তোমার সম্মুখে/এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে/তার জন্যে অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে/তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্য প্রদক্ষিণের পথে/যে বিপুল নিমেষগুলি উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে/তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোন একটি আসনের/সত্য মূল্য যদি দিয়ে থাকি/জীবনের কোনো একটি ফলবান খণ্ডকে যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে/তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে/সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে/যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম  অচিনের মধ্যে যায় মিশে/হে উদাসীন পৃথিবী,/আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে/তোমার নির্মম পদপ্রান্তে/আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।" 

    ------

Post a Comment

2 Comments

  1. দিদি তোমার লেখা অনবদ্য ।তুমি নিশ্চুপতারপ্রকাশ ।/তুমি সূর্য -তারায় ভরা এক আকাশ ।।

    ReplyDelete
  2. দিদি তোমার এই প্রয়াস একবাক্যে অব্যক্ত।শুভেচ্ছা রইল ।। jui saha.

    ReplyDelete