জ্বলদর্চি

রাজর্ষি রায়


রা জ র্ষি  রা য় 

এই সময় ও রবীন্দ্রনাথ


রবীন্দ্রনাথ সমগ্র ভারতের আধ্যাত্মিক ও মানবিক চিন্তার সাকার বিগ্রহ স্বরূপ। গোটা পৃথিবীর মানব-ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন ক'টা মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়?হাতেগোনা যে কয়েকজন মানুষ, মানব-ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছেন তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম অগ্রণী পথিক। আজ থেকে প্রায় ১০০বছর আগে 'গীতাঞ্জলি' মানুষকে পথ দেখিয়েছিল মুক্তির। আর আজ এই গৃহবন্দী মানুষের কাছে তিনি যে প্রাসঙ্গিক তা বলাই বাহুল্য।
রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনে যে সত্য, শিব ও সুন্দরের আরাধনা করেছেন তাকেই তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বার বার বলার চেষ্টা করেছেন। ১৯৪১ সালে 'সভ্যতার সংকট '-এ তিনি বলছেন-
 "মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।"
এই আশাতেই আমাদেরও বুক বাঁধতে হবে। আমরা তাঁর দর্শনে যদি বিশ্বাস রাখি তবে এই কালি-মাখা মেঘ একদিন কেটে যাবেই। তিনি মৃত্যুর পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে ভয়াবহতা দেখেছিলেন, তাতে নাগিনীদের নিঃশ্বাস শুনতে পেয়েছিলেন। তাই কি আশি বছর বয়সে তিনি তাঁর 'সানাই' কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় 'ক্রুর বিধাতা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন? সেই কারণে আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর 'আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে সঠিক প্রশ্ন তোলেন:
তবে রবীন্দ্রনাথও কি শেষজীবনে অন্তত একবারের মতোও 'ব্ল্যাসফেমি'র (ঈশ্বরের নিন্দা) আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন? তাহলে কি তিনি সত্য-শিব-সুন্দরের উপর শেষজীবনে আস্থা হারিয়ে ছিলেন? 
তার উত্তর হল- 'না'।
তিনি তাঁর গান ও কবিতায় বারে বারে যে সুন্দরের আরাধনা করেছেন তাকেই শেষ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে চলেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। তাঁর জীবন তাই আমাদের কাছে বহু নিভৃত ও কঠিন অনুজ্ঞার সাধনা করতে শেখায়। আইয়ুব সাহেব তাই যথার্থই বলেন--
"কিন্তু কোন কালে,কোন দেশে একজন মানুষও যদি 'নিজ মর্ত্যসীমা' চূর্ণ করে থাকে, দুঃখের সীমান্ত খুঁজতে  বেরিয়ে থাকে, তবে সেইখানে আমরা দেখতে পেয়েছি 'নক্ষত্রের ইঙ্গিত'। ভুল হয়নি, সেই একটি মানুষ মনুষ্যত্বকে রক্ষা করেছে দ্বিপদবিশিষ্ট পশুত্বের গ্রাস থেকে, বলে গেছে--এ জগত স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন নয়, কাফকার উপন্যাস নয়।"
তিনি তাঁর গীতবিতানে'র প্রথম কবিতায় বলেছিলেন-
"শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন মাঝে/অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।"
কবি সেই বিশ্বদেবতার পদে প্রণাম জানান। যে বিরামবিহীন মহাওঙ্কার ধ্বনি হৃদয়ে ঝংকার তোলে তারই মধ্যে তিনি বিচিত্র সুর শুনতে পান। একে'র অনলে বহু'রে আহুতি দিয়ে আত্মিক তপস্যার সাধনা করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের পথ তাই বিশ্ব পথিকের পথ। আর বিশ্বলোকের পথের মধ্যেই তিনি অনন্তের সন্ধান করেন। বিচিত্র ঈশ্বর অনুভূতির মধ্য দিয়েই তিনি ঐক্যের সূত্র স্থাপন করেন। সেই কারণে কবি বুদ্ধদেব বসুর মতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করে-
"...............হে বন্ধু যদি না
লিপ্ত হতো রক্তে মোর বিদ্ধ হতো গূঢ় মর্মমূলে /তোমার অক্ষয় মন্ত্র।অন্তরে লভেছি তব বাণী/ তাইতো মানি না ভয়, জীবনেরই জয় হবে জানি।"

---------

Post a Comment

1 Comments