জ্বলদর্চি

সৈয়দ কওসর জামাল


সৈ য় দ  ক ও স র  জা মা ল


চিরকৃষ্ণপক্ষ

আমিও বিক্ষুব্ধ হলে জলের মতোই ছলকে উঠি, অন্ধকার!
সময় প্রক্ষিপ্ত ছায়া, আঁচলে জড়ানো যার চাবি, কথারাত
হাতের মুঠোয় ধরা অবয়বহীন রেখা,  নীচে বালি, ক্ষার
আমি কি তেমন ঝঞ্ঝা, হাওয়ায় উড়িয়ে নেবো তোমাকে হঠাৎ?

চিরশূন্য গর্ভগৃহ, অহমিকা তীব্র নদী, কৌলীন্য শেখায়
তটভূমি ভেঙে পড়ে, তৈজসজীবন ভাসে, ভেসে যায় জলে
তেমন প্লাবক নই, প্রপাতের শব্দ শুনি ললাটলেখায় 
তুমি চির কৃষ্ণপক্ষ, তোমাকে ডেকেছি এই বিপন্ন অতলে!


পাশুপত

আফিমে আচ্ছন্ন জনপদ
নাগরিক গভীর নিদ্রায়
নিম্নগামী আত্মার পারদ
মেধাবৃত্তি ছায়াচ্ছন্নপ্রায় ।

মাথার ভিতরে শত কীট
সহনশীলতা কেটে নামে
এসময় অকাল প্রাবৃট
সূর্যাস্ত দেখেছি মধ্যযামে।

তুমি অহঙ্কার কল্পতরু
আত্মবিনাশের জতুঘর
উপশমে মরীচিকা-মরু
নৈরাজ্য তোমার সহোদর।

এ সময় অন্ধ, নিশীথিনী
এ সময় সংবর্ত, সংহার
এ সময় তুমি আহ্লাদিনী
মৃত্যু ও ত্রাসের সমাচার।

আলোড়ন তোমার নিষ্ক্রিয়
স্নায়ুযুদ্ধে করেছ নির্ভর
শেষ তাস স্পষ্ট করি, প্রিয়
ছিলায় যোজিত, দ্যাখো, শর।
জরায়ুজলের ওম

পুনরায় সমুদ্রগর্জন শুনি ভ্রমণের ইচ্ছের ভিতর
অন্ধকারভাঙা পথে বালিস্তূপ ইগলুগৃহের মতো স্বেচ্ছায় নির্মিত
এই সব গৃহে গৃহে শঙ্খনাদ চাপা গোঙানির মতো কামনানশ্বর
দূরে জেলেদের নৌকো থেকে মৃদু আলো সময়বিভ্রম হয়ে
                               নক্ষত্রের মতো জ্বলে নেভে
মাদকনিশির এই ক্ষণে 
আমাদের লবণাক্ত দাঁতের পিপাসা গাঢ় হয়
উপকূলজুড়ে হিংস্র উল্লাসে মেতেছে এক মারণবাতাস
তাদের উন্মাদ ক্রোধ তীর থেকে  পৃথিবীর বাজারের দিকে ধাবমান
মুহূর্ত সন্ধিক্ষণের
বিপন্ন উষার চোখে চোখ রাখে রাত্রিবিবমিষা
ভ্রমণে আকাঙ্ক্ষাবদ্ধ আমি কালরজনীর পোড়া স্নায়ুজুড়ে 
                                 এঁকেছি যাত্রার পথ
নেমে পড়ি ঝঞ্ঝাজলে
উষ্ণতা জরায়ুজল
তার ওম আমাকে তৎক্ষণাৎ জড়ায় দুহাতে ।
শরীর শরীর

শরীর ডাকিনীবিদ্যা, গূঢ় তন্ত্রাভাস
না জেনেই প্রশ্রয় দিয়েছি তাকে এতকাল, এখনো নাছোড়
এখনো বাতাসে তার কলহনিশ্বাস
চেয়েছে বশ্যতা, রতিঘোর ।

শরীর ক্ষমতাসম, স্বৈরতন্ত্রকামী
স্বাধীনতা চক্ষুশূল, অনন্ত জীবন মানে রাত
উধাও আলোর পথ, অন্ধতাও বহুদূরগামী
অস্ত্র শক্তিহীন, শুষ্ক জলের প্রপাত ।

শরীর বিশ্বাসহীন, যুদ্ধের প্রান্তর
কত যে মাইন, অস্ত্র পোঁতা
সাবধানে হাত রাখি—অবলুপ্ত এই পরিসর
আমার নিক্ষিপ্ত বাণ, গতিহীন, ভোঁতা ।

কী নেই তোমার মধ্যে ? শব্দবাণ, ধ্বংসের উল্লাস
বাগী সিপাহির মতো আমার  দিনকাল
পতঙ্গডানায় উড়ি, আর শুনি ডাকিনীনিশ্বাস
পাথর-চকমকি চাই, সঙ্গে চাই তোমার কঙ্কাল ।


কালকথা কালো কথা

বেশুমার গালাগালি, অবশেষে গলাগলি, পাপে ও ঈশ্বরে
পাপ প্রতিবেশী, নিয়মিত দেখা হয়, আর ঈশ্বর সুদূর
তবু তাঁর উদ্দেশে সমস্ত ব্রজ্যা এই গলিপথে শেষ হয়
আত্মনিবেদন থেকে বিস্ময়ের শুরু, পাপ বলি যাকে, সেও
জাগতিক প্রেক্ষাগৃহে নাট্যশাস্ত্র শিখে পটু বেমক্কা সংলাপে...
ঈশ্বর রাজার মুখ, দেওয়ালে অজস্র কান, প্রজামনে গতি
বাতাস সেলাম ঠুকে সন্ধিপত্র দিয়ে যায় যুদ্ধের প্রাক্কালে
ফলত দুপক্ষ প্রীত, দিন যায়, শীতগ্রীষ্ম যায় একে একে
পাপের কলহচিহ্ন, পোকায় ক্ষয়িত দাঁত জলে ধুয়ে যায়
শুধু কালো মন তার আলো মেখে চাকচিক্য ক্রমশ বাড়ায়...

এই দৃশ্যে হাওয়া দোল খায়, ত্বক ফেটে রক্ত ঝরে
ঈশ্বরপ্রতিম রাজা উত্তেজিত, এ বিবেক মধ্যবিত্ত, পাতি
বরাভয় দেন তিনি স্নেহ ভরে অকৃতীর কৃতাঞ্জলিপুটে 
ঈশ্বরতাবিজ কণ্ঠে বসুন্ধরা সরাজ্ঞান, প্রহরী নিদ্রিত
চৌর্যের ওপরে কেউ করে বাটপারি, শৌর্যরথ কুম্ভগামী
আত্মপ্রতারণা হাড়ের ভিতরে শীতকাল হয়ে ঢোকে।

সূর্য ডাকো, ডাকো গ্রীষ্ম, চৌদ্দপুরুষের আগুনসঞ্চয়
পুড়ে পুড়ে আরো কালো, কালো হবে রিপুর অক্ষর
বাতাসে নড়েছে ধর্ম, কথার বিস্ফারে জাগে বধিরতা 
আগুন নেভার পর ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে ওঠে অর্থহীন
ততক্ষণে কালো ছাই, সন্ত্রস্ত অক্ষরলিপি বৃত্ত পূর্ণ করে
এই রাত বৃত্ত-পরিক্রমণের, বিপরীতমুখী দুই টান
পৃথিবী দ্বিবিধ করে, হিসেব সরলরেখা, সাদাকালো
সত্যিই সরল এত...এখানে দাঁড়াই দ্বিধান্বিত
ভূপৃষ্ঠও দুলে ওঠে, টের পাই ভূকম্পন, তড়িৎপ্রদাহ
সোনার কলসখানি ডুব দেয় পানাপুকুরের ঘোলাজলে।
------

Post a Comment

4 Comments

  1. Sandipkanjilal
    ধন্যবাদ জানাই জলদর্চিকে।আবার সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্য ।

    ReplyDelete
  2. Prantika Maity

    দারুন হয়েছে।

    ReplyDelete
  3. কবিতা পড়তে পড়তে জীবনানন্দের প্রকৃতিপ্রেম আর সুধীন দত্ত ও বিষ্ণু দে'র শব্দ চয়নের বিষয়টি বারে বারে মনে করায়।

    ReplyDelete